হার্ট এর নানান সমস্যা
ডাঃ কৃতান্ত দত্ত
2019-04-16 13:01:14
মানুষের আড়াইশো গ্রাম ওজনের হৃদযন্ত্রটি মাতৃজঠের পাঁচ সপ্তাহ থেকে তার স্পন্দন শুরু করে ও যতদিন না আমরা ওপরে উঠছি তা চলতেই থাকে। হৃদযন্ত্র তার স্পন্দন চালিয়ে যায়। প্রতি মিনিটে স্পন্দন সত্তর হয় । ভেবে দেখুন আমাদের সচল রাখার জন্য হৃদযন্ত্র কত সচেতনভাবে তার দায়িত্বপালন করে চলেছে। অথচ তাকে ভালো রাখার জন্য আমরা কী করি? সকাল বা সন্ধ্যায় হাঁটাহাঁটি করি না, প্রেসার, সুগার, রক্তে লিপিড বা কিডনি থেকে হার্টের অসুখ হলে তা যাতে ভালো থাকে তার ন্যূনতম দায়িদ্ব পালন করি না।
হার্টের নানারকম অসুখ। রিউম্যাটিক হার্ট, ইসকিমিক হার্ট, হাইপারটেনসিভ হার্ট, থাইরোটক্সিকোসিস হার্ট, কার্ডিওমায়োপ্যাথি ও মায়োকার্ডাইটিস। এছাড়া কিছু হার্টের অসুখ আছে যেগুলো পাশ্চাত্য দেশে দেখা যায়। পেনিসিলিন প্রতিষেধক ও ভালো আর্থ-সামাজিক অবস্থার দৌলতে রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিজ পাশ্চাত্য দেশ থেকে উধাও। আমাদের লজ্জার ব্যাপার এই রোগ দেখার জন্য পাশ্চাত্য দেশের লোকেরা আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোতে ভিড় জমান। এছাড়া আছে বয়স্কদের জন্মগত হার্টের অসুখ ও হার্টের কনডাক্টিং সিস্টেম বিকলতার জন্য সিক সাইনাস সিনড্রোম বা হার্ট ব্লকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর অসুখ।
বেশি বয়সে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলোর পরিবর্তন ঘটে, যার প্রভাব আবশ্যকীয়ভাব হার্টের ওপর এসে পড়ে। হোমিওস্ট্যাসিস রিজার্ভের সংকোচন শুরু হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার এটি শুরু হয় তিন দশক থেকে এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এর জন্য বয়স্ক ব্যক্তিদের রোগের একদম প্রথম অবস্থায় লক্ষণ দেখা দেয়। দু’ একটি উদাহরণ দিই। মাঝবয়সী কারও থাইরয়েড হরমোনের ক্ষরণ বেশি হলে (হাইপার থাইরয়েডিজম) হার্টের ওপর তার প্রভাব নাও পড়তে পারে। বয়ষ্কদের এটা শুরু হয় হার্ট ফেলিওর দিয়ে। রক্তে সুগারের মাত্রাধিক্যে বয়স্করা অনেক সময় ননকিটোটিক হাইপারঅসমোলার কোমায় চলে চলে যেতে পারেন।
গড় আয়ু আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়েছে। সুতরাং ক্যানসারের মতো বয়স্কদের হার্টের রোগগুলোর প্রকোপ দিন দিন বেড়ে চলেছে। যদিও এই অসুখগুলোর ক্ষেত্রে জেনেটিক ও লাইফস্টাইল ফ্যাক্টর কাজ করে। বয়স হচ্ছে প্রধান রিস্ক ফ্যাক্টর।
বয়ষ বাড়ার সাথে হার্ট ও রক্তনালীর যে পরিবর্তন ঘটে তা সংক্ষেপে বলি। বয়স বাড়ার সাধে ধমনীর দেওয়াল শক্ত হয়ে যায় (ইনটিমাল থিকেনিং)। ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়। ব্লাড প্রেসার নির্ধারিত হয় কার্ডিয়াক আউটপুট ও পেরিফেরাল ভাসকুলার রেজিস্ট্যান্সের ওপর। বয়স্কদের ক্ষেত্রে অনেকটা নির্ভর করে রক্তনালীর নমনীয়তার ওপর।
রক্তনালীর মধ্যে এন্ডোথেলিয়াল কোষ থাকে। হার্ট ফেলিওর, হাইপার টেনশন, রক্তে লিপিডের আধিক্য, সুগারের আধিক্য এই রোগগুলির এন্ডোথিলিয়াল ডিসফাংশন হয়। এই কোষগুলো থেকে নাইট্রিক অক্সাইড, এনডোথিলিন-১ নির্গত হয় যা ধমনীর নমনীয়তা বাড়ায়। বয়স বাড়লে রক্তনালীর ওপর এই নমনীয়তা কমে যায়।
ন্যাশনাশ হেলথ ও নিউট্রিশান এক্সামিনেশন ও ফার্মিংহাম হার্ট স্টাডিতে দেখা গেছে বয়স বাড়ার সাথে হাইপার টেনশন, বাম নিলয়ের সাইজ বৃদ্ধি ও হৃদযন্ত্রের ছন্দবৈকল্য বাড়ে।
বয়স বাড়ার সাথে কনডাক্টিং সিস্টেমের পরিবর্তন হয়। হার্টের পেসমেকার সাইনোএট্রিয়াল নোডের চারপাশে ফাইব্রোসিস হতে থাকে। পেসমেকার সেলের সংখ্যা কমতে থাকে। সাইটোস্কেলিটনের চারপাশে কমবেশি ক্যালসিফিকেশন হতে শুরু করে। এ.ডি নোড, বান্ডেল অফ হিস কাছাকাছি থাকতে সিক সাইনাস সিনড্রোম ও হার্ট ব্লক হয়।
বয়স বাড়ার সাথে কার্ডিয়াক ইনডেক্স ও হার্ট রেট পঁচিশ শতাংশ কমে যায়। হার্টের এনডায়াস্টলিক ভল্যুউম ত্রিশ শতাংশ বাড়ে। পাম্পিং ক্ষমতা পনেরো শতাংশ কমে যায়। রক্তে ক্যাটেকোলামিন বাড়ে। বিটা অ্যাড্রেনারজিক উত্তেজক হার্টের প্রতিক্রিয়া কমে যায়।
হার্ট ভালভের অসুখ
চারটি ভালভের মধ্যে মাইট্রাল ও অ্যাওরটিক ভালভের রোগ বেশি। অনেক ক্ষেত্রে অল্প বয়স ও মাঝবয়সী রিউম্যাটিক মাইট্রাল স্টেনোসিস বেশি বয়সে ধরা পড়ে। এছাড়া বয়স বাড়ার সাথে ভালভের চারপাশে ক্যালসিয়াম জাতীয় পদার্থ জমা হতে শুরু করে ও ভালভ সরু হয়ে যায়। ভালভের মিক্সোমেটাস ডিজেনারেশন ও ইস্কেমিয়া থেকে মাইট্রাল রিগারজিটেশন হতে পারে।
বয়স বাড়ার সাথে অ্যাওরটিক ভালভে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস ও ডিজেনারেটিভ পরিবর্তন হয়। তা সত্ত্বেও ভালভ স্বাভাবিক কাজ করতে পারে বা মাইট্রাল ভালভের মতো স্টেরোসিস বা রিগারজিটেশন ঘটাতে পারে। ইকোকার্ডিওগ্রাফি ও এল.ডি অ্যাঞ্জিও করে ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।
দুটো ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি অনুযায়ী সারাজীবন ওষুধ দিয়ে বা অ্যাসথেটিক ভালভ প্রতিস্থাপনের কথা ভাবা হয়।
হার্ট অ্যাটাক ও ইস্কেমিয়া
বয়স বাড়ার সাথে হার্টের ধমরীর অ্যাথেরোস্ক্লেরোটিক বাধা বেড়ে যায়। ঠিকঠাক চিকিৎসা না হলে বা অনিয়মিত চিকিৎসা হলে পরিণতি হয় অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন বা হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাক হতে হলে রিস্ক ফ্যাক্টর থাকতে হবে। এটা পরিবর্তনীয় বা অপরিবর্তনীয় হতে পারে। প্রথমগুলো হল ধূমপান, রক্তে লিপিডের আধিক্য, বেশি রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, বসে থাকা জীবসযাপন ও টাইপ-এ পার্সোনালিটি (সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত)। অপরির্বনীয় রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হল বয়স, ছেলে ও বাড়িতে কারও (প্রথম ডিগ্রি আত্মীয়) হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। মাসিক বন্ধের আগে হরমোনজনিত কারণে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অ্যাটাক কম হয়। বন্ধ হয়ে গেলে হরমোন প্রতিরক্ষা থাকে না এবং বেশি বয়সে মেয়েদের অ্যাটাক তুলনামূলকভাবে বেশি হয় এবং অ্যাটাক পরবর্তী জটিলতাও (কমপ্লিকেশন) মেয়েদের বেশি।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ
বেশি বয়সে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ অন্যান্য বয়সের মতো এক নাও হতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের আদর্শ লক্ষণ হল বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি। পঞ্চাশ শতাংশ বয়ষ্ক লোক আসেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে। তাছাড়া মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড়, হাঁটাচলায় অসংগতি থাকতে পারে।
ওপর পেটের মাঝখানে ব্যথা ও বমি নিয়েও এই রোগ উপস্তিত হতে পারে।
পঁচিশ শতাংশ বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের কোনো লক্ষণ থাকে না বা খুবই কম থাকে (সাইলেন্ট মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন)। বয়স্ক লোক ছাড়া ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন ও অপারেশন পরবর্তী রোগীদের ক্ষেত্রে এস.এম.আই বেশিমাত্রায় হয়।
বয়ষ্কদের হার্ট অ্যাটাক সন্দেহ হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ির মধ্যে র্যানিটিডিন ও ফ্যামোটিডিন জাতীয় ওষুধ খাইয়ে দিয়ে দুটো অ্যাসপিরিন জাতীয় ট্যাবলেট (১৫০মিগ্রা) চিবিয়ে খাইয়ে দিন। যদি অ্যাসপিরিনে অ্যালার্জি থাকে তাহলে দুটো ক্লোগিডেগ্রল (৭০ মিগ্রা)। সিস্টোলিক ব্লাড প্রেসার ১০০ মিমি পারদের মাত্রা বেশি থাকলে জিভের নীচে নাইট্রোগ্লিসারিন ট্যাবলেট (৫ বা ১০ মিগ্রা) দেওয়া যায়।
গ্রাম বা শহরে বাড়িতে বসে সাধারণ লোকের পক্ষে এর চেয়ে বেশি কিছু করা যায় না। হার্ট অ্যাটাকের প্রথম তিন ঘন্টা স্বর্ণময় মুহূর্ত ধরা হয় (গ্লোল্ডেন টাইম)। কারণ এই সময়ের মধ্যে বয়স বা অন্যান্য কারণে রোগীর থ্রম্বোলাইটিক থেরাপি শুরু করা না গেলে করোনারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি (প্রাইমারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি) বা বাইপাসের কথা ভাবা হয়।
থ্রম্বোলাইটক থেরাপি শুরু করার পর অ্যাঞ্চিওপ্লাস্টি করা হলে সেটাকে বলা রেসকিউ অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি ।
হৃদযন্ত্রের ছন্দবৈকল্য
হৃদযন্ত্রের ডান অলিন্দের (অ্যার্টিয়াম) ভিতরে এস.এ. নোডের মধ্যে থাকে হার্টের আসল পেসমেকার। এর কাজ হল মিনিটে ষাট থেকে সত্তর তার্ট রেট ঠিক রেখে তা ছন্দে পরিচালিত করা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে হৃদযন্ত্রের ছন্দবৈকল্য শুরু হতে পারে যদি হার্টের কোনো অসুখ থাকে এবং ঠিকঠাক চিকিৎসা করা না হয়। অ্যার্টিয়াল এক্টোপিক, ভেনট্রিকুলার এক্টোপিক, অ্যার্টিয়াল ও ভেন্ট্রিকুলার ফিব্রিলেশন হার্টে বিভিন্ন রকমের ছন্দবৈকলের লক্ষণ।
এছাড়া বয়স বাড়ার সাথে কিছু ক্ষেত্রে হার্টের পেসমেকারের পাশে ফাইব্রোসিস ও অবক্ষয়জনিত কারণে (ডিজেনারেটিভ) তৈরি হয় সিক সাইনাস সিনড্রোম ও সম্পূর্ণ হার্ট ব্লক (লেভস ও লেনেগ্রা ডিজিজ)। যে কারণে ছন্দবৈকল্য হয় (ইস্কেমিয়া, হাইপারটেনশন, থাইরয়েড) তার চিকিৎসা সাথে চলে। তবে শেষের দুটো কারণের চিকিৎসা হার্টের মধ্যে আর্টিফিসিয়াল পেসমেকার ইমপ্ল্যান্টেশন। যাদের পেসমেকার বসানো আছে, তারা বুক পকেটে মোবাইল রাখবেন না এবং যেকোনো ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ডিভাইস থেকে পেসমেকারের দূরত্ব হবে ন্যূনতম ছয় ইঞ্চি।
হার্ট ফেলিওর
হার্ট ফেলিওরের অনেকগুলো কারণের মধ্যে প্রধান দুটি কারণ বয়স্কদের মধ্যে হল হাইপারটেনশন ও ইস্কেমিয়া। হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট, বুকধড়ফড় বা চোখের সামনে আঁধার দেখা ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়া ফেলিওরের অন্যতম লক্ষণ। এছাড়া রাত্রে ঘুমের ঘোরে হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট হয়ে উঠে পড় (প্যারক্সিম্যাল নকচারনাল ডিসপিনিয়া) লেফট ভেন্টিকুলার ফেলিওরের লক্ষণ। বুকের এক্স-রে, ই.সি.জি ও ইকোকার্ডিওগ্রাফি রোগ নির্ণয় ও সুনিশ্চিত করার মূল অস্ত্র। হার্ট ফেলিওর হলে পাম্পিং ক্ষমতা (ইজেকশান ফ্র্যাকশন ) কমে যায়। বৃদ্ধ বয়সের হার্টের গুরুত্বপূর্ণ অসুখ হলে ইস্কেমিক কার্ডিও মায়োপ্যাথি যাতে পাম্পিং ক্ষমতা ভীষণভাবে কমে যায়। সারাজীবন চেক আপ ও ওষুধপত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের সমাজে বয়স্করা আজও অবহেলিত। সংসারে সারা জীবন দিয়েও এই বয়সে পাই খুব কম। বেশিরভাগ সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলিতে জেরিয়াট্রিক মেডিসিন ও কার্ডিওলজি বিভাগ আছ। বয়স্করা এই সুযোগ গ্রহণ করে সুস্থ থাকুন।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় স্বাস্থ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন